সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজারও প্রশ্ন দেখতে পাবেন যেখানে পুরুষরা নারীদের সতীত্ব নিয়ে সন্দেহ করে। যেমন
- “মেয়ে দেখতে গিয়ে কিকরে বুজবেন মেয়ে কারো সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বা প্রেম ছিলো কি না?”
- “আজ কালকার দিনে কি কোনো সতী মেয়ে পাওয়া যাবে?”
- “আমার প্রেমিকার আগে একটা প্রেম ছিল। আমার ভাবতে কষ্ট লাগছে যে তার শরীরে আগে কেউ হাত দিয়েছে। আমার কি করা উচিৎ?”
এই রকম হাজার হাজার প্রশ্ন দেখতে পাবেন। এগুলো আসল সমস্যা নয়। আমরা লক্ষণ নিয়েই ভাবছি। কিন্তু আমরা এই সমস্যার গভীরতা বুজতে পারি না। আসুন ব্যাপারটা গভীরে তলিয়ে বোজা যাক। এবং সমাধান খোজার চেষ্টা করা যাক।
ওথেলো সিনড্রোম বা সন্দেহ বাতিক রোগ কি জানেন?
বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক উইলিয়াম শেকসপিয়র রচিত একটি ট্র্যাজেডি নাটক হলো “ওথেলো” । নাটকটির মূল নাম দ্য ট্র্যাজেডি অফ ওথেলো । এই নাটকের মূল চরিত্র হলো এক সামরিক অফিসার যার নাম ওথেলো। ওনার স্ত্রীর নাম ছিলো ডেসডিমোনা। ডেসডিমোনা আদর্শ স্ত্রী হলেও ওথেলো তাকে খুব সন্দেহ করতো। বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে ওথেলো শেষ পর্যন্ত তার স্ত্রী ডেসডিমোনা কে হত্যা করেন। এই নাটকটি রচনা করা হয়েছিল ১৫০০ শতকে। যখন বিজ্ঞান শিশুর মতো হাঁটছিলো। কিন্তু ওই সময়েও শেকসপিয়র এটিকে একরকম মানসিক অবস্থা বলেছিলেন । বিংশ শতকে যখন মনোবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন বিজ্ঞানীরা শেকসপিয়র বর্ণিত ওই মনস্তাত্বিক অবস্থা কে নাম দেন ওথেলো সিনড্রোম বা সন্দেহ বাতিক রোগ।
নিজের সঙ্গীর সতীত্বের ওপর আসক্তির মতো সন্দেহ করা কে বলে ওথেলো সিনড্রোম । মূলত পুরুষরাই এই রোগের শিকার হন। তবে মহিলাদেরও এই রোগের শিকার হতে দেখা যায়। ওথেলো সিনড্রোমের রোগী চিকৎসকের শরণাপন্ন হতে চান না। নিজেকে সবসময় সুস্থ মনে করেন। নিজের ধারণাটিকে ্রভবে িশ্বাস করেন। এই মিথ্যা অলীক বিশ্বাসের কারণে অনেক সময় এসব রোগী তাদের স্ত্রীকে হত্যা পর্যন্ত করেন।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নরহত্যা করার জন্য জেলে গেছেন এমন লোকের মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশই ‘ওথেলো সিনড্রোম’-এর রোগী। বিভিন্ন কারণে এই রোগ হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতা, সিজোফ্রেনিয়া, মদে আসক্তি প্রভৃতি। এ ছাড়া কিছু শারীরিক অসুখের কারণেও ‘ওথেলো সিনড্রোম’ হতে পারে। যেমন মস্তিষ্কে টিউমার, এন্ডোক্রাইন ও বিপাক ক্রিয়ার ত্রুটি প্রভৃতি।
কি করে বুজবে আপনার ওথেলো সিনড্রোম হয়েছে?
স্ত্রীর সতীত্বের প্রতি তীব্র সন্দেহবোধ হলো ওথেলো সিনড্রোম রোগের প্রধান উপসর্গ। রোগী মনে করেন, তার স্ত্রী গোপনে অন্য পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করেন। স্ত্রী যদি সামান্য সাজগোজ করেন, তাহলে রোগী মনে করেন গোপন প্রেমিকের জন্যই এই সাজগোজ। এ নিয়ে রোগী সবসময় উদ্বিগ্ন থাকেন। এক ধরনের ক্রোধ তার মধ্যে কাজ করে। সামান্য কথাতেই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন।
তার বন্ধুদেরও সন্দেহের চোখে দেখেন। তার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করে। খাবারের প্রতি অনীহা আসে। স্ত্রীর অসততা প্রমাণ করার জন্য গোপনে স্ত্রীর প্রতি নজর রাখেন। স্ত্রীর কাপড়-চোপড় গোপনে পরীক্ষা করেন। গোপনে স্ত্রীর ডায়েরি ও কাগজপত্র াঁটাঘাঁটি করেন। স্ত্রীর নামে কোনো চিঠি এলে তা সরিয়ে ফেলেন। পড়ে দেখতে চান তা কার লেখা। অনেক সময় স্ত্রীর গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্য লোক নিয়োগ করেন। বাসায় ফোন থাকলে মাঝে মধ্যেই ফোন করে দেখেন স্ত্রী বাসাতেই আছে কি-ন। োন েজড থাকলে তার বিশ্বাস দৃঢ় হয়।
রোগীর মধ্যে প্রচ ঈর্ষার জন্ম নেয়। কথায় কথায় স্ত্রীকে মারধর করেন। রোগীর নিজের মধ্যে কোনো সততার বালাই থাকে না। তার নিজের যৌন অসততার প্রতিফলন তার স্ত্রীর মধ্যেই দেখেন। স্ত্রীর চারিত্রিক কল্পিত অসততার কথা আত্মীয়-স্বজনকে বলেন। পদে পদে স্ত্রীকে হেয় করতে চান। স্ত্রী অপমানিত হলে মনে মনে খুশি হন। স্ত্রীকে নানাভাবে নির্যাতন করেন।
জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করতে চান। রোগী নিজেকে সবসময় অপূর্ণ মনে করেন। তার বিশ্বাস জন্মায় যে, স্ত্রী তার অর্জিত টাকা-পয়সা অবৈধ প্রণয়ের পেছনে খরচ করে তাকে নিঃস্ব করতে চায়। এসব চিন্তা করে তার স্ত্রীকে নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেন। দুশ্চিন্তায় রোগীর স্বাস্থ্যহানি ঘটে। অনিদ্রা দেখা দেয়। মদে বা অন্য নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। স্ত্রী সন্তান প্রসব করলে সেই সন্তানকে অবৈধ মনে করে তাকেও তিনি নির্যাতন করে থাকেন। স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি তার প্রচণ্ড ঘৃণা জমে উঠতে থাকে।
ওথেলো সিনড্রোম রোগের কি চিকিৎসা হয়?
অবশ্যই হয়। ওথেলো সিনড্রোম’ চিকিৎসা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। চিকিৎসক স্ত্রী ও স্বামী দু’জনের সঙ্গে পৃথ পৃথক কথা বলেন এবং তাদের কথা শোনেন। দাম্পত্য জীবনের বিস্তারিত বিবরণ জানাটা অপরিহার্য। রোগীর বিশ্বাসের ভিত্তি এবং স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে হবে। রোগীকে বিশেষ মাত্রায় অ্যান্টি সাইকোটিক ওষুধের পাশাপাশি ‘বিহেভিয়ার থেরাপি’ প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। োগীর অন্য কোনো অসুখ আছে কি-না, াও ভালমতো দেতে হবে।
আমি বলছিনা যে আপনার এই রোগ হয়েছে। কিন্তু এখনই ধ্যান না দিলে এই রোগ হতে পারে। সন্দেহ যখন ঘরের দুয়ারে দাঁড়ায়, ভালবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়’- এটি শুধু কোনো কথার কথা নয়, শতভাগ সত্য। সবধরনের সম্পর্কের বড় শত্রু হলো সন্দেহ। একটি সুন্দর সম্পর্ককে নিমেষে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে সন্দেহ নামের ঘুনপোকা।
সন্দেহ মানুষের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য। সন্দেহবিহীন মানুষ পাওয়া দায়। মনোচিকিৎসকদের মতে, নিরাপত্তাহীনতা থেকেই মানুষের মনে সন্দেহ পোকা আস্তানা গাড়ে। কারণ, জীবনে প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো ঘটনায় অজানা আশঙ্কা ভর করে। আর সেখান থেকেই মনের ঘরে সন্দেহের জন্ম। একে প্রশ্রয় দিলে মস্তিষ্কে শিকড় ছড়িয়ে ডালাপালা মেলে দেয়। একসময় সন্দেহ করাটা ম্যানিয়াতে রূপান্তরিত হয়। জীবনকে করে তোলে জটিল। এই জটিলতার মধ্যে থাকে ক্ষোভ, ঈর্ষা, হতাশা আর হীনমন্যতা। শুধুমাত্ সন্দেহের কারনে পৃথিবীতে লক্ষ-কোটি সম্পর্ক ভেঙে গেছে।
ওথেলো সিনড্রোম বা সন্দেহ বাতিক রোগ কে দূরে রাখতে কি করা উচিৎ ?
সন্দেহ প্রবণতা দূর করার কিছু উপায় বলছি। প্রয়োগ করে দেখুন। কাজে দেবে।
১. স্ত্রীর সঙ্গে খোলামেলা ভাবে কথা বলুন
প্রিয়জনের কোনো কর্মকাণ্ডে যদি আপনার প্রশ্ন তৈরি হয়, কোনো দরকার নেই তা চেপে রাখার। সরাসরি কথা বলুন, জানতে চান তার কারণ। দেখবেন, আপনি যা ভাবছেন, তার সিংহভাগই ভুল। কথা বলেই পেয় যেে ারেন সিছুর ব্যাখা। ন্ধ হবে মনের গহীনে সন্দেহের বংশবৃদ্ধি একইভাবে আপনার সঙ্গী যেন কোনোভাবেই কোনোকারণে আপনাকে সন্দেহ করতে না পারে, এ বিষয়ে সতর্ক থাকুন সবসময়।
সম্পর্কের শুরুতেই তাকে বলে রাখতে পারেন, কোনো বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হওয়ার আগেই যে আপনার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলে। তারপরও যদি কোনো কারণে আপনাকে সে সন্দেহ করছে বলে টের পান, নিজেই এগিয়ে যান। প্রিয়জনের মনে বানোয়াট ধারণাগুলোর ব্যাখা দিয়ে সন্দেহকে সমূলে বিনাশ করে দিন।
২. স্ত্রীর সঙ্গে অনেক সময় দিন
স্ত্রীর সঙ্গে যতোবেশি সময় কাটাবেন, ততোই সন্দেহ দূরে পালাবে। তাই ভালবাসার মানুষটির সাথে বেশি বেশি সময় কাটানোর চেষ্টা করুন। এতে দুজন দুজনকে বুঝতে পারবেন। পরস্পরের মধ্যে তৈরি হবে আস্থা আর বিশ্বাস। তখন আর কারো মনে সন্দেহের মেঘ জমার কোন অবকাশই থাকবে া।
ধরে রাখুন শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস যে কোনো সম্পর্কের ভিত্তিই হলো শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস। আপনি যখনি আপনার সঙ্গী অথবা ভালোবাসার মানুষটিকে মন থেকে বিশ্বাস করবেন দেখবেন এসব সন্দেহের কালিমা আপনার ধারে কাছেও আসবে না। তাই একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রাখুন।
ব্যস্ততা যখন সন্দেহ নির্মূলের অস্ত্র কথায় আছে অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। তাই নিজেকে যথাসম্ভব ব্যস্ত রাখুন।আপনি অলস ছেন বলে হয়তো ভালবাসার মানুষটিকে নিয়েই ভেবে যা্েন। কিন্তু যাকে নিয়ে ভাবছেন সে হয়তোবা আপনাে সেভাবে সময় দিতে পারছে না। এমন অবস্থায় মনে সন্দেহের মেঘ জমতে পারে। তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।
৩. আবার অতি ব্যস্ততাও অনেক সময় সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তৃতীয় পক্ষের থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন।
প্রয়োজনে তৃতীয়পক্ষ থেকে দূরে থাকুন।
অনেক সময় তৃতীয় কোনো ব্যক্তির আবির্ভাব দুজনের সম্পর্কে সন্দেহের বিষ ছড়িয়ে দিতে পারে। যদি তৃতীয়পক্ষকে আপনার সঙ্গী সহজভাবে মেনে নিতে পারছে না। অকারণে আপনাদের সন্দেহ করছে। প্রথমে চেষ্টা করুন তার ভুল ধারণা ভেঙে দিতে। তারপরও যদি দেখেন, সমস্যা থাকছেই। তাহলে সম্পর্কের স্বার্থেই আপনাকে তৃতীয়পক্ষ পরিত্যাগ করতে হবে।